মা
অনির্বচনীয় মায়া-মমতা—শ্রদ্ধা-ভালোবাসা—কৃতজ্ঞতায় মাখা— বহু সুখস্মৃতি জাগিয়ে তোলা— বড় আদরের ছোট্ট একটি নাম— ‘মা’।
অতীতে মায়ের স্নেহ-আঁচলতলে থাকা বহু ভাগ্যবান মানুষই ‘মা’-এর কথায় স্মৃতিবেদনাতুর হয়ে ওঠে। আর বর্তমানে থাকা মানুষতো ‘মা’-এর মায়া-আবেশে আচ্ছন্ন। এদের কন্ঠে মাতৃস্তুতি শোনাযায়, —“মা মাত্রেই মঙ্গলময়”, “—জগতের সব মা-ই সমান”, “—মা সবাইকে সমান চোখে দেখে...”।
কিন্তু, ‘মা’ কথাটি উচ্চারণ বা স্মরণের সাথে সাথে সবার মনেই যে ঐরূপ সুখানুভূতি জেগে উঠবে, —এমন নয়। এই জগতে মাতৃস্নেহ বর্জিত— তিক্ত বা বিরূপ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন —মাতৃসুখ বিহীন —ভাগ্যহীন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
অনেক অন্ধ মাতৃভক্তকেই (না জেনে— নাবুঝে —অন্ধ ভাবাবেগে) তাদের উদ্দেশে— “নরাধম” —“অকৃতজ্ঞ” —“পাপীষ্ঠ”... বলতে শুনেছি। বলতে শুনেছি, —“নরকেও তোদের জায়গা হবে না” ইত্যাদি। এরা এতই অজ্ঞান— মোহাবিষ্ট —অন্ধ-বিশ্বাসী, যে জগতের আসল রূপটা এদের কাছে অধরাই থেকে যায়। মুক্ত মনে— খোলা চোখে জগতের স্বরূপ দেখা সম্ভব হয়না এদের পক্ষে।
আমরা মায়ের মহিমান্বিত রূপ যেমন দেখেছি, তেমনি অজ্ঞান-অন্ধ —লোভাতুর—কামাতুর— হিংসা-বিদ্বেষ প্রবণ —কুচক্রী— ঈর্ষাকাতর —হিংস্র-নিষ্ঠুর —অত্যাচারী—পাপাচারী —অপরাধপ্রবন মা-এর দেখাও আমরা পেয়েছি। সারা দেশে যত অপরাধী মহিলা আছে, তারা অনেকেই কারো না কারো ‘মা’। দেখেছি, পথের কাঁটা— সন্তানকে খুন ক’রে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে। দেখেছি, অন্ধ-বিশ্বাসে অপদেবতার কাছে সন্তানকে বলি দিতে। এ’রকম বিভিন্ন ধরনের অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে— আমাদের চারিপাশে।
এই জগতটাই একটা মায়াময় জগত। এর স্রষ্টাকেও অনেকে মাতৃজ্ঞানে— মহামায়া মলে থাকেন। ‘মা’ আর ‘মায়া’ অতি নিকট সম্পর্কযুক্ত। জীব বা মানুষ মায়ের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। এই জগতে যেমন বিভিন্ন প্রকারের মানুষ আছে, তেমনি ‘মা’-ও আছে নানা ধরণের। সত্যানুসন্ধিতসু —মুক্ত-মন নিয়ে এই জগতে বিচরণ করলেই তা’ দেখতে পাওয়া যাবে।
‘মায়া’ কথাটির অন্যতম অর্থ হলো— ভ্রান্তি —মোহ —বিভ্রম, —ভুল ধারণা বা বিশ্বাস। এই মায়ার জগতে প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের মতোই— জ্ঞানী ‘মা’-ও দুর্লভ।
একজন জ্ঞানী ‘মা’ —তার সন্তানকে কখনোই মায়ার আঁচলতলে বেঁধে রাখেন না। তিনি তার সন্তানকে প্রকৃত জ্ঞানী ক’রে তুলতে— পৃথিবীর মুক্ত পাঠশালায় —মুক্তমনে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা—শিক্ষালাভের সুযোগ ক’রে দেন। জ্ঞানী ‘মা’ চান— তার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠুক। প্রকৃত মানুষ।
মাতৃসুখে বঞ্চিত এমন অনেক ব্যক্তিকে দেখেছি, যাঁরা মায়ের আঁচলতলে থাকার সুযোগ না পেয়ে, অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা সহ্য ক’রে— অবশেষে জগতটাকে তার স্বরূপে দেখার—জানার সুযোগ পেয়ে, জীবনের মূল লক্ষ্যে পৌঁছে— মানবজীবন ধন্য করতে পেরেছেন।
এখন, মজার ব্যাপার হলো— কেউ মায়ার আঁচলতলে নিরাপদ আশ্রয়ে— ‘সুখে আছি’ ভেবে, নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছে। আবার কেউ, শত দুঃখ-কষ্ট সত্বেও, মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশে— জীবনের লক্ষ্যপানে অনেকটা এগিয়ে যেতে পেরে, —নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে।